আপনার ছেলে প্রেম করলে জাত যায় না। মাস শেষে কড়াইগন্ডায় মাইনে বুঝিয়ে দিলেও জাত যায় না। কিন্তু আপনার ছেলে বিয়ে করতে চাইলে আপনার জাত চলে যায়। শুধু সমস্যা নয়, মস্ত বড় সমস্যা হয়। তখন আপনার মস্তিষ্ক হঠাৎ করে আপনাকে জানান দেয় আপনার ছেলের বিয়ের বয়স হয়নি। অথচ আঠারো বছরের একটা ছেলেকে আপনার কাজে পাঠানোর সময় এই কথাটা একটাবারের জন্যও মনে আসেনি। আপনার মনে আসলো তখন যখন সে আরেকজনের দায়িত্ব নিতে চাইলো। তখন মনে হলো ছেলের ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে। ঘরের ছাদ দেওয়ার কাজ এখনো বাকি। আপনি সেজন্য সহজ সমাধান বের করে বলে ফেললেন, প্রেম করছিস কর; আরও পাঁচ বছর পর বিয়ে করিস।
কারণ প্রেমিকার কাছে তো আর দায়বদ্ধতা থাকে না, খরচ নেই। কেন ভাই সিস্টেমটা এমন বানাচ্ছেন কেন?
ছেলে দুইদিন কাজ না করে বাড়ি বসে থাকলে আপনারাই আবার ছিচিক্কার ফেলেন বয়স হয়েছে, কাজ না করে পায়ের উপর ঠ্যাং তুলে বসে আছে কেন? বাপের হোটেলে খাচ্ছে কেন?
অথচ বিয়ের কথা বললেই গরম তেলে বেগুন ভাজার মতো ছ্যাঁত করে ওঠেন। তখন আপনাদের মনে হয় আহারে সোনা বাচ্চা আমার। ও তো এখনো পিচ্চি খোকা, একেবারে ফিডার খায়।
বেকার ছেলে বিয়ে দিতে আপনাদের জাত চলে যায়। ছেলে কাজ করলে বিয়ে দিতেও জাত চলে যায়। কারণ ক্যারিয়ার গড়া নাকি হয়নি। নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করতে চাইলে তো কোনো কথাই নেই। তখন তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে বসে থাকেন।
মেয়েদের বেলায় তো আরও উচ্চমর্গীয় চিন্তাভাবনা। সবকিছু একসাথে চাই। কর্মঠ, সুদর্শন, সরকারি চাকরিজীবী না হলে তো একেবারে জাত চলে যায় কিনা। এত উচ্চ পর্যায়ের জাত নিয়ে আপনারা সমাজে বসবাস করেন কীভাবে?
পাশের বাসার এক ছেলেকে দেখছি দীর্ঘ ছয়মাস বাবা-মায়ের পেছনে ঘুরছে বিয়ে করবে বলে। বলতে বলতে তার মুখের ফেনা উঠে গেলেও বাবা-মায়ের টনক নড়ছে না। অথচ সেই ছেলেই যখন দুইদিন আগে বিয়ে করে বউ ঘরে তুলেছে তখন বাপ-মায়ের জাত গেল জাত গেল বলে হাহুতাশ।
পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের একটা মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখেন পড়াশোনার দোহাই দিয়ে। মেয়েটাও বাপ-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে টুঁ শব্দটাও করে না। বিয়ের কথা বললেই বাবা-মা হেসে হেসে বলে, কী আর বলবো হারি! মাইনসের ছেলেমেয়ে শুনি প্রেম করে বিয়েশাদি করে। আমার বলদ মাইয়াটা তো সেটাও করতে পারে না। করলে তো বেঁচেই যেতাম। এত ঝক্কি কে সামলাতে যাবে। পড়াশোনাটা শেষ হোক তারপর নাহয় দেখা যাবে।
বয়স হয়নি বয়স হয়নি বলে বিয়ে না দেওয়া মেয়েটাকেই এখন বেশি বয়সের দোহাই দিয়ে পাত্রপক্ষ রিফিউজ করে। অবশ্য ত্রিশ বছরের ছেলেও যদি পনেরো বছরের পাত্রী খোঁজে তবে তো বয়স্ক মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
সেদিন শুনলাম মেয়েটা নাকি নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে। আর বাবা-মায়ের এতদিন বাদে টনক নড়েছে। তাদের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিশক্তি হঠাৎ ফিরে পেয়ে মনে হয়েছে তাদের একটা মেয়ে ছিল, যে কিনা নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেছে। ছি ছি কী কেলেঙ্কারি কী কেলেঙ্কারি! পরিবারের এখন জাত যায় অবস্থা।
প্রতিবেশী এক কাকীকে দেখি ছেলে বিয়ে করতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে কান্নাকাটি করে বঙ্গোপসাগর বানান। হাসপাতালে ভর্তি করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করেন। তিনটা ছেলের বিয়ের সময়ই একই কাহিনি। এই কান্নার রহস্যটা আমার আজও অজানা।
বিয়েতে কিছু নেবো না বলে জাতে উঠে যাওয়া কাকী আবার পরমুহূর্তেই বলে ওঠেন, শুধু ঘরটা সাজিয়ে দিলেই হবে। আমাদের অবশ্য কোনো দাবিদাওয়া নেই। কিছু না দিলে কেমন জাত চলে যায় না! মানুষজন কী বলবে!
অমুকের বউটা শুনলাম কাইল্লা ভূত। তার উপর আবার জাতের যা ছিরি; খুলুর ঘরের খুলু। কোনো চোখ দিয়ে দেখে যে ওই মেয়েকে বিয়ে করলো। ম্যা গো ম্যা গো।
তমুকের বউয়ের নাকি আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল। আগের পক্ষে নাকি একটা মেয়েও আছে। কী সব্বনাশা কথা। মরে যাই মরে যাই।
এত সুন্দর মেয়েটার বর কিনা এমন মোটা, কালো, ভুড়িওয়ালা। একটুও মানায়নি। ছি ছি ছি!
আরে ভাই, এত কেন সবকিছুতে আপনাদের সমস্যা বলুন তো? নাক সিটকানোর অভ্যাসটা একটু বদলান না। যে যার যার মতো করে ভালো থাকুক। নিজেকে নিয়ে ভাবুন, নিজের পরিবার নিয়ে ভাবুন। কোন কাজটা কোন সময় করতে হয় সেই লেসনটা একটু পাঠ করুন। সবকিছুকে কি পাটের রশি পেয়েছেন যে ইচ্ছেমতো গিট্টু পাকাবেন?
বেশি গিট্টু পাকালে কিন্তু রশিটাও একসময় অকেজো হয়ে যায়, আমাদের সমাজব্যবস্থা এখন যেমন হয়েছে।
সবকিছু সহজভাবে নিতে না পারলে কঠিনও করবেন না। মানুষের ব্যক্তিত্বকে, ব্যক্তিগত মতামতকে এবং প্রয়োজনটাকে মূল্য দিতে শিখুন। বিশ্বাস করুন তাতে আপনার জাত মোটেও চলে যাবে না।
@জাত গেল
__ ✍️ নীলিমা নওরীন মেঘলা
.jpeg)
0 মন্তব্যসমূহ